অবরোধ শিথিল হলেও ১৪৪ ধারা বহাল,শর্তক অবস্থানে প্রশাসন,টহল জোরদার,জনভোগান্তি চরমে।
আল-মামুন:: খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় সংঘাতের পর আতঙ্ক কাটেনি এখনো। পূর্বে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ খাগড়াছড়ি জেলায় সিমাবন্ধ থাকলেও পরে তা তিন পার্বত্য জেলায় বৃদ্ধি করে আন্দোলনরত জুম্ম ছাত্র-জনতা। সংঘাতের পর থেকে ১৪৪ ধারা জারিসহ শর্তক অবস্থানে রয়েছে প্রশাসন। মাঠে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ,সেনাবাহিনী,বিজিবি,আর্ম পুলিশ কাজ করছে। জোরদার করা হয়েছে টহল। খাগড়াছড়ি ও গুইমারার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে অতিরিক্ত পুলিশ,সেনাবাহিনীসহ প্রশাসনের অবস্থান ছিলো লক্ষ করার মত।
অন্যদিকে- নাম পরিচয় শনাক্ত হয়েছে গুইমারায় সংঘাতে নিহত ৩ জনের। তারা হলেন, গুইমারার বটতলা পাড়ার বাসিন্দা হ্লাচাই মারমার ছেলে থোয়াইচিং মারমা (২৫), সাইংগুলি পাড়ার বাসিন্দা আপ্রু মারমা ছেলে আখ্র মারমা (২৪) ও গুইমারার হাফছড়ি গ্রাম লিচু বাগানের বাসিন্দা থোয়াইহ্লাঅং মারমার ছেলে আথুইপ্রু মারমা (২)।
নিহতদের লাশ খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতাল মর্গে থাকলেও এখন পর্যন্ত তাদের ময়না তদন্ত হয়নি বলে জানিয়েছে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) রিপল বাপ্পি চাকমা। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি বলেও তিনি জানান।
সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫) দুপুর ১২টা থেকে খাগড়াছড়ি চট্টগ্রাম-ঢাকা সড়কে শিথিল করা হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য ডাকা সড়ক অবরোধ। জুম্ম ছাত্র-জনতা নিজস্ব পেইজ থেকে এ ঘোষনা দেয়া হয়।
খাগড়াছড়িতে অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে সকাল-সন্ধ্যা অবরোধের মধ্যেই শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫) দুপুর খাগড়াছড়িতে সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে রূপ নেয় খাগড়াছড়ি। পরে দুপুর ২টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন।
পর দিন রবিবার (২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫) ১৪৪ ধারার মধ্যে উপজেলার খাদ্য গুদাম সংলগ্ন রামসু বাজারের মুখে আগুন জ্বালিয়ে পিকেটিং করাকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনীর সাথে পাহাড়িদের সংঘর্ষ এবং পরে তা স্থানীয় বাঙ্গালীদের সাথে সংঘাতে রূপ নেয়।
সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন পাহাড়ি নিহতের ঘটনা ঘটে। আহত হয় ১৩ সেনা সদস্য এবং গুইমারা থানার ওসিসহ ৩ পুলিশ সদস্য। সংঘাত চলাকালে গুইমারার রামসু বাজারে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। পুড়িয়ে দেয় অসংখ্য পাহাড়ি-বাঙালীর দোকান পাট ও বাড়ি। এ সময় জ্বালিয়ে দেয়া হয় মোটর সাইকেলও।
এ নিয়ে এখনো কোন মামলা হয়নি বলে জানিয়েছে গুইমারা থানার (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) ওসি- মো: এনামুল হক চৌধুরী। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় এখনো শর্তক অবস্থানে আছে প্রশাসন। খাগড়াছড়ি এবং গুইমারার ঘটনায় পাহাড়ি ও বাঙালীদের অসংখ্য মানুষ আহত হয়। ভাংচুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত চয়ন শীল নামে এক কিশোরকে আটক করেছে পুলিশ। ওই কিশোর বর্তমানে ৫ দিনের রিমান্ডে রয়েছে। অজ্ঞাতনামা আরো ২ জন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারের দাবিতে জুম্ম ছাত্র-জনতার ডাকে খাগড়াছড়িতে সকাল-সন্ধ্যা সড়ক অবরোধ ডাকে। শনিবার সকাল থেকে অবরোধের কারণে খাগড়াছড়ির সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাঙামাটির সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া খাগড়াছড়ি জেলা সদরের সাথে দীঘিনালা, পানছড়ি, রামগড়, মহালছড়িসহ ৯ উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে।
এমন পরিস্থিতিতে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার খাগড়াছড়ি পৌরসভা ও সদর উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি এবং জনগণের জান ও মালের ক্ষতিসাধনের আশঙ্কা দেখা দেয়ায় ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ১৪৪ ধারা জারি করেন জেলা প্রশাসক।
এদিকে রোববার খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলেছেন, অপরাধীদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। ধর্ষণকারী, নারী নির্যাতনকারী, অস্ত্রধারী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানান।
এ সময় তিনি ভবিষ্যতে যেন পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত তৈরি না হয়, সে জন্য প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় আনার কথা জানান। এতে তিনি বাঙালি ও পাহাড়ি সব সম্প্রদায়কে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে আমরা অসাম্প্রদায়িক হতে চাই বলে মত দেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশ সুন্দর রাখতে হবে এবং আসন্ন দুর্গাপূজা ও প্রবারণা পূর্ণিমা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে সবাইকে সহযোগিতার আহ্বান জানান উপদেষ্টা।
সে সভায় জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকারের সভাপতিত্বে উপদেষ্টার একান্ত সচিব (উপসচিব) খন্দকার মুশফিকুর রহমান, সদর জোন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. খাদেমুল ইসলাম, পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেফালিকা ত্রিপুরা অংশ নেন।
সভায় খাগড়াছড়ি শহরে মহাজনপাড়ায় ঘটে যাওয়া ঘটনার নিন্দা জানিয়ে দোষীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান স্থানীয় প্রতিনিধিরা। সম্প্রতি এক ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়িতে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় বলে এতে জানানো হয়।
আটকরা পড়া সাজেকের কয়েক হাজার পর্যটককে প্রশাসন নিরাপত্তা দিয়ে চট্টগ্রামসহ গন্তব্যে পৌছে দেওয়ার ববস্থা নেয়া হয়। অন্যদিকে- চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি প্রবেশের মুখে শতাধিক পণ্যবাহী গাড়ি আটকে পড়ায় স্থানীয় বাজারে খাদ্য ও নিত্যপণ্যের সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। জনদুর্ভোগও ক্রমাগত বাড়ছে।
দুপুর পর্যন্ত জেলার প্রবেশমুখ ফটিকছড়ি উপজেলার নয়াবাজার চেকপোস্টে গিয়ে দেখা যায়, সরকারি খাদ্যগুদাম ও স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করার জন্য আসা গো-খাদ্য, পোলট্রি খাদ্য এবং আপেল, আঙুরসহ রোগীবাহী (ডায়াবেটিক) পণ্যবাহী শ খানেক ট্রাক সড়কে দাঁড়িয়ে আছে।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার জানান,স্থানীয় ও সাধারন জনগণের জানমালের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ১৪৪ ধারা বলবৎ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাসহ সকল প্রশাসন কাজ অব্যাহত রয়েছে। পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা মুক্ত হলেই ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হবে বলে তিনি জানান। এ সময় বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে বলে জানান।