সব
facebook raytahost.com
চুক্তি'র ২৮ বছরে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি | Protidiner Khagrachari

চুক্তি’র ২৮ বছরে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

চুক্তি’র ২৮ বছরে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটা ২রা ডিসেম্বর ২০২৫। দেখতে দেখতে আটাশটা বছর পার হয়ে গেল। আটাশ বছর কোনো কম সময় নয়, একটা পুরো প্রজন্মের বেড়ে ওঠার সময়। অথচ পেছনের দিকে তাকালে মনে হয়, এই তো সেদিন ১৯৯৭ সাল। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের দীর্ঘদিনের রক্তক্ষরণ থামানোর এক বুক আশা নিয়ে তৎকালীন সরকার আর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জে এস এস) মধ্যে সই হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক ‘শান্তি চুক্তি’।

চার খণ্ডে বিভক্ত এই চুক্তিটা তখন মনে হয়েছিল পাহাড়ের বুকে চেপে বসা পাথরটা হয়তো এবার সরবে। কিন্তু আজ, এই ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে যখন পেছনে তাকাই, তখন মনে প্রশ্ন জাগে, পাহাড় কি আসলেই শান্ত হয়েছে? নাকি সেই সবুজ পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে জমে আছে বারুদের গন্ধ আর দীর্ঘশ্বাসের বাষ্প? চুক্তি হয়েছিল ঠিকই, কাগজের পাতায় সই-সাবুদও পাকা, কিন্তু পাহাড়ের সাধারণ মানুষের বুকের ভেতর যে অস্থিরতা, সেটা কি বিন্দুমাত্র কমেছে? আজ চুক্তির ২৮ বছর পূর্তিতে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই।

চুক্তির পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে একটা ধোঁয়াশা চোখে পড়ে। কাগজে-কলমে হিসাবটা বেশ পরিষ্কার। চুক্তির চারটি খণ্ড—ক, খ, গ আর ঘ। সব মিলিয়ে ৭২টি ধারা। সরকারি খাতা বলছে, এই ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি নাকি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। শুনলে মনে হবে, বাঃ! বেশ তো অগ্রগতি! ৪৮টি ধারা মানে অর্ধেকেরও বেশি কাজ শেষ। খাতা-কলমের এই হিসাবে আরও দেখা যায়, ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে আর বাকি ৯টি ধারার কাজ চলছে।

সরকারের বিভিন্ন সূত্র তো বেশ জোর দিয়েই বলছে, ক খণ্ডের ১ থেকে ৪ নম্বর ধারা সবকটিই বাস্তবায়িত। খ খণ্ডের বিশাল তালিকা ১, ২, ৩, ৫ থেকে শুরু করে একদম ৩৩ পর্যন্ত অধিকাংশ ধারাই আলোর মুখ দেখেছে। একইভাবে গ খণ্ডের ১, ৭, ৮, ৯, ১০, ১২, ১৪ এবং ঘ খণ্ডের ১৯টি ধারার মধ্যে ১১টিই বাস্তবায়িত। এই তালিকার দিকে তাকালে যে কেউ ভাববে, পাহাড়ে তো এখন স্বর্গ নেমে আসার কথা।

১৯৯৮ সালে এই চুক্তির ফসল হিসেবেই তো পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় তৈরি হলো। নিঃসন্দেহে এটা একটা বড় মাইলফলক ছিল। কিন্তু সমস্যাটা হলো, মাইলফলক ছুঁয়েই যদি আমরা দাঁড়িয়ে থাকি, গন্তব্যে আর না পৌঁছাই, তাহলে সেই মাইলফলকের সার্থকতা কতটুকু? সরকারি ফাইলের এই ৪৮টি ‘সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত’ ধারার সুফল কি পাহাড়ের বসবাসরত সাধারণ মানুষ- পাহাড়ি কিংবা বাঙালিরা আদৌ পাচ্ছে?

সবচেয়ে পীড়াদায়ক বিষয় হলো ভূমি বিরোধ। কার জমি কে দখল করল, কে কাকে উচ্ছেদ করল এই নিয়েই তো যত মারামারি, কাটাকাটি। শান্তি চুক্তিতে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কথা খুব গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হয়। উক্ত কমিশনকে আইনী কাঠামো দেয়ার জন্য ১৭ জুলাই ২০০১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১ প্রণয়ন করা হয়।

২০০১ সালের প্রণীত আইনে উল্লিখিত ‘‘চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলিয়া গণ্য হইবে’’ শব্দগুলির পরিবর্তে, ২০১৬ এর সংশোধনীতে ‘‘চেয়ারম্যানসহ উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের গৃহীত সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলিয়া গণ্য হইবে’’ শব্দগুলি প্রতিস্থাপিত করা হয়। এর ফলে চেয়ারম্যানের বিচারিক ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত’কে অবদমিত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজাতি সদস্যের সিদ্ধান্তই কমিশনেরসিদ্ধান্ত হিসেবে গৃহীত হওয়ার মত অযৌক্তিক আইন সন্নিবেশিত  করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে ৯ জন সদস্যের মধ্যে ৭ জন উপজাতি এবং ২ জন সম্ভাব্য বাঙালী।

পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্ধেক জনগোষ্ঠী বাঙালী হলেও কমিশনে পার্বত্য জেলায় বসবাসরত বাঙালীদের কোন প্রতিনিধিত্ব নেই। সংশোধনী অনুযায়ী চেয়ারম্যানসহ কমিশনের সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত কমিশনের গৃহীত সিদ্ধান্ত হবে বিধায় উপজাতি সদস্যদের মতামতই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। ফলশ্রুতিতে, বাঙালীদের ন্যায্য দাবীর পক্ষে সিদ্ধান্ত পাওয়া প্রায় অসম্ভব হবে এবং বাঙালীদের উচ্ছেদের হুমকিসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান/স্থাপনা উচ্ছেদের সম্ভাবনা তৈরী হবে। এছাড়াও, জমি সংক্রান্ত বেশিরভাগ বিরোধের সাথে বাঙালী জনগোষ্ঠী জড়িত থাকলেও কমিশনে কোন বাঙালী প্রতিনিধি নেই।

শান্তিচুক্তির পূর্বে অনেক উপজাতি ভারতে যাওয়ার পূর্বে তাদের জায়গা জমি বাঙালীদের নিকট বিক্রি করে যায়। পরবর্তী শান্তি চুক্তির পর তারা প্রত্যাবর্তন করে এবং বিভিন্ন মহলের ইন্ধনে সরকারী খাস জমিসহ তাদের বিক্রিত জমিও অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের বলে দাবি করে। এমতাবস্থায় এ ধরনের বিরোধ নিষ্পত্তিকল্পে এবং কমিশন কর্তৃক নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উক্ত কমিশনে বাঙালী প্রতিনিধির উপস্থিতি প্রয়োজন।

পার্বত্য  চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থাপনার অন্যতম অংশীদার জেলা প্রশাসকগণকে উক্ত কমিশনের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা জরুরী। এখানে উল্লেখ্য যে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণত তিন শ্রেণীর জমি রয়েছে যেমন, ব্যক্তি মালিকানা, সরকারী খাস জমি ও বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চল।

স্থানীয় উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকজন/নেতৃবৃন্দ সরকারী খাস জমি ও বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভূমিসহ সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিজেদের ভূমি বলে মনে করে এবং এ লক্ষ্যে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি (Customary Laws) অনুযায়ী ভূমি বিরোধের নিষ্পত্তি প্রত্যাশা করে; যা বাংলাদেশের প্রচলিত ভূমি আইন ও সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।  পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩ জন সার্কেল চীফ পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি, ১৯০০ অনুযায়ী সরকারের ভূমি রাজস্ব আদায় করার জন্য নিযুক্ত হলেও সময়ের পরিক্রমায় তারা নিজেদের কথিত ‘রাজা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ভূমি সমস্যার সমাধান হলে সার্কেল চীফদের এ ধরনের প্রভাব- প্রতিপত্তি খর্ব হওয়ার আশংকা থেকে তারাও ভূমি সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানে আগ্রহী নয়।

ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০১৬ জারী হবার পর বিচারপতি (অব.) মো. আনোয়ারুল হক এর নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গত ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখ হতে ৪৫ দিনের সময় বেঁধে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরোধপূর্ণ ভূমির ব্যাপারে দরখাস্ত আহবান করেন।

পরবর্তীতে এ বিষয়ে সময়ের বাধ্যবাধকতা রহিত করা হয়। অদ্যাবধি কমিশন বরাবর মোট ২২৯৭০টি (খাগড়াছড়ি-৭,৯০৮, রাঙ্গামাটি-৯,৯২৪ ও বান্দরবান-৫,১৫৮) আবেদন জমা পড়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৫৭৪ জন বাঙালী এবং অবশিষ্ট ২২,৩৯৬ জন এর সবাই উপজাতি। উপজাতিদের অভিযোগ/আবেদন ৯৭.৫০% ও বাঙালীদের ২.৫০%। উল্লেখ্য, কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ ও পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সহিংসতার কারণে প্রায় এক লক্ষ লোক ভোগ দখলকৃত জমি ত্যাগ করে ভারতে চলে যায়, যাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক পরিবার উক্ত এলাকায় বসবাসরত বাঙালীদের নিকট তাদের বসতভিটা ও জমি বিক্রয় করে দিয়ে যায়।

পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পরে ভারত প্রত্যাগত উপজাতি শরণার্থীসহ অনেকে কিছু কুচক্রী মহলের ইন্ধনে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে গণহারে অভিযোগ/আবেদন করায় এবং অন্যদিকে বিদ্যমান কমিশনের উপর বাঙালীদের আস্থা না থাকায় উপজাতিদের আবেদন/অভিযোগের পরিমাণ বাঙ্গালীদের চাইতে উল্লেখযোগ্য হারে বেশি।

গত ৫ আগস্টের দ্বিতীয় স্বাধীনতা’র পর পাহাড়ের মানুষও নতুন করে স্বপ্ন দেখছে। কারণ, পতিত স্বৈরাচারী সরকার গত দেড় যুগে পাহাড় নিয়ে যে রাজনীতি করেছে, তা ছিল মূলত তোষণ আর বিভাজনের রাজনীতি। জে এস এস-এর সাথে চুক্তি করার পর আওয়ামী লীগ সরকার এমন এক নীতি নিয়েছিল, যেখানে মনে হতো পাহাড়ের নিয়ন্ত্রণ বুঝি কেবল একটি বিশেষ গোষ্ঠীর হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

২০১৬ সালে জে এস এস-এর চাপে পড়ে সরকার ভূমি কমিশন আইন সংশোধন করল। সেই সংশোধনী ছিল একতরফা। ৯ সদস্যের কমিশনে একমাত্র বাঙালি সদস্য ছিলেন চেয়ারম্যান, তার ক্ষমতাও এমনভাবে ছাঁটাই করা হলো যে, ওই আইনে বাঙালিদের ভূমির অধিকার আদায়ের আর কোনো রাস্তাই খোলা রইল না। এটা কি কোনো ন্যায়বিচার হলো? পাহাড়ে তো শুধু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ থাকে না, সেখানে লাখ লাখ বাঙালিও বাস করে। তাদেরও তো বেঁচে থাকার, মাথা গোঁজার ঠাঁই
পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু ওই সংশোধিত আইনে তাদের সেই অধিকারকে কৌশলে হরণ করা হয়েছে।

চুক্তির পরবর্তী সময়ে পাহাড়ে শান্তির বদলে আমরা কী দেখলাম? দেখলাম ভাইয়ে-ভাইয়ে সংঘাত। আগে যেখানে লড়াইটা ছিল অনেকটা সরকার বনাম শান্তিবাহিনীর, চুক্তি পরবর্তী সময়ে সেটা হয়ে দাঁড়াল পাহাড়ের ভেতরের ক্ষমতার লড়াই। গত দেড় যুগে পাহাড়ে নতুন করে ৬টি সশস্ত্র গ্রুপের জন্ম হয়েছে। এরা কারা? এরা তো আকাশ থেকে পড়েনি। এরা পাহাড়েরই সন্তান, কিন্তু হাতে তাদের অস্ত্র। খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণ, গুম এমন কোনো অপরাধ নেই যা তারা করছে না। পাহাড়ের সাধারণ মানুষ, সে পাহাড়ি হোক বা বাঙালি, আজ এদের হাতে জিম্মি।

পর্যটকরা পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে মুগ্ধ হয়, কিন্তু তারা জানে না, সন্ধ্যার পর ওই সুন্দর উপত্যকাগুলোতে কেমন ভয়ের রাজত্ব কায়েম হয়। আগে মানুষ বাঘের ভয় পেত, এখন পায় এই সশস্ত্র গ্রুপগুলোর। জে এস এস-এর সাথে সরকার চুক্তি করল শান্তির জন্য, অথচ সেই জে এস এস-এর বিরুদ্ধেই অভিযোগ, তারা বিভিন্ন অজুহাতে ভূমি কমিশনকে কাজ করতে দেয়নি। তাদের মূল লক্ষ্য যেন ছিল বিরোধ জিইয়ে রাখা। বিরোধ থাকলেই রাজনীতি থাকবে, ফায়দা লোটা যাবে। ফলশ্রুতিতে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। যে কয়টা ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছিল, সব কটিই ব্যর্থতার দায় নিয়ে বিদায় নিয়েছে।

উল্লেখ্য গত ২৮ আগস্ট ২০২৫ ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. নাজমুল আহসান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল হাফিজ-কে নিয়োগ দিয়েছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। তাঁকে আগামী ৩ বছরের জন্য এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

পাহাড়ের এই যে অস্থিতিশীলতা, এর পেছনে মূল কারণ হলো আস্থার সংকট আর সঠিক পরিকল্পনার অভাব। ভূমি বিরোধ মেটাতে হলে সবার আগে যেটা দরকার, সেটা হলো সঠিক ভূমি জরিপ। আধুনিক যুগে ড্রোন দিয়ে,স্যাটেলাইট দিয়ে কত সহজে জরিপ করা যায়। কিন্তু পাহাড়ে আজ পর্যন্ত সঠিক কোনো ভূমি জরিপ হয়নি।

কেন? কারা চায় না জরিপ হোক? যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়, তারাই জরিপ হতে দেয় না। কার জমি কতটা, সেটা নির্ধারিত হয়ে গেলে তো আর দখলের রাজনীতি চলবে না। তাই এই কমিশনকে কার্যকর করতে হলে সবার আগে আইন সংশোধন করতে হবে। তারপর দল-মত নির্বিশেষে জরিপ চালাতে হবে। জরিপের মাধ্যমে যখন বিরোধপূর্ণ জমির সঠিক অবস্থান আর মালিকানা নির্ধারিত হবে, তখনই কেবল সমাধানের পথে হাঁটা সম্ভব।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বেসামরিক প্রশাসন পাহাড়ে একটা কঠিন দায়িত্ব পালন করছেন। তারা নিরলসভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে। কিন্তু এক হাতে তো তালি বাজে না। প্রশাসনের একার পক্ষে এই শান্তি ধরে রাখা সম্ভব নয়, যদি না পাহাড়ের ভেতরের মানুষগুলো, বিশেষ করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতারা আন্তরিক হন। এখানে একটা বড় সমস্যা হলো দোষারোপের সংস্কৃতি।

পাহাড়ি নেতারা দোষ দেন বাঙালিদের, বাঙালি নেতারা দোষ দেন পাহাড়িদের, আর সবাই মিলে দোষ দেয় সরকারকে। এই চক্র থেকে বের হয়ে আসতে হবে। চুক্তির যেসব ধারা, বিশেষ করে খ ও গ খণ্ডের ধারাগুলো এখনো ঝুলে আছে, সেগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা দরকার। লুকোচুরি খেলে কোনো লাভ নেই। অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু সংস্কারের কথা বলছে, তাই এটাই মোক্ষম সময়। ভূমিসহ অমীমাংসিত সব বিষয় নিয়ে সব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের এক টেবিলে বসতে হবে। কাউকে বাদ দিয়ে নয়। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বাঙালি সবার কথা শুনতে হবে। কারণ,পাহাড়টা সবার।

এখানেই আসে সেই দক্ষিণ আফ্রিকার উদাহরণ। ১৯৯৪ সালে সেখানে যখন বর্ণবাদের অবসান হলো, তখন তো শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে রক্তের নদী বয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু আর ম্যান্ডেলা মিলে এক জাদুকরী ধারণা নিয়ে এলেন—‘রেইনবো নেশন’ বা রংধনু জাতি। তারা বললেন, প্রতিশোধ নয়, আমরা গড়ব এক নতুন জাতি যেখানে সব রঙের, সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার থাকবে। তারা ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ বা সত্য ও মিটমাট কমিশন গঠন করেছিলেন। আমাদের পাহাড়েও আজ এমন একটা মানসিকতা দরকার। পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস আর শ্রদ্ধাবোধ ছাড়া কোনো চুক্তিই টিকবে না।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কি পারব? আমরা কি পারব পাহাড়ে একটা ‘রেইনবো নেশন’ গড়ে তুলতে? যেখানে মসজিদের আজান আর প্যাগোডার ঘণ্টা বা মন্দিরের উলুধ্বনি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে? যেখানে পাহাড়ি মেয়েটি নির্ভয়ে স্কুলে যাবে, আর বাঙালি কৃষকটি নিশ্চিন্তে তার জমিতে হাল দেবে? কাজটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। এর জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা আর পাহাড়ের মানুষের সচেতনতা। গত ৫ আগস্টের পর আমরা দেখেছি, ছাত্র-জনতা চাইলে অনেক অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়। পাহাড়েও এখন সেই তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। পুরনো নেতারা যদি ব্যর্থ হন, তবে নতুনদের এগিয়ে আসতে।

‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার, নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার সবার’ এই কথাটা শুধু স্লোগান হয়ে থাকলে চলবে না। এটাকে পাহাড়ের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে গেঁথে দিতে হবে। এবার হোক আসল শান্তির শুরু। যে শান্তি আসবে ন্যায়বিচারের হাত ধরে, যে শান্তি আসবে সমঅধিকারের ভিত্তিতে। পাহাড়ের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে পড়ুক এই বার্তা।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক, কলামিস্ট ও সদস্য, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ।
Email : msislam.sumon@gmail.com

আপনার মতামত লিখুন :

তাইন্দং এলাকায় জামায়াত প্রার্থীর গণসংযোগ

তাইন্দং এলাকায় জামায়াত প্রার্থীর গণসংযোগ

বেগম জিয়ার রোগমুক্তি কামনা যুবদলের

বেগম জিয়ার রোগমুক্তি কামনা যুবদলের

সিঁড়ি নির্মাণ ও ক্রীড়া সামগ্রী বিতরণ

সিঁড়ি নির্মাণ ও ক্রীড়া সামগ্রী বিতরণ

জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন

জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন

কৃষি ব্যাংকের উদ্যোগে ঋণ আদায় ক্যাম্প

কৃষি ব্যাংকের উদ্যোগে ঋণ আদায় ক্যাম্প

১০ম গ্রেডের দাবিতে স্মারকলিপি

১০ম গ্রেডের দাবিতে স্মারকলিপি

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
সম্পাদক ও প্রকাশক : সৈকত হাসান
বার্তা সম্পাদক : মো: আল মামুন সিদ্দিক
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা।
ফোনঃ ০১৮৩৮৪৯৯৯৯৯
ই-মেইল : protidinerkhagrachari@gmail.com
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। Design & Developed By: Raytahost .com